৯.৩.৬ ভূমিকম্প (Earthquake)

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বিজ্ঞান - দুর্যোগের সাথে বসবাস | NCTB BOOK

পৃথিবীর ভেতরে হঠাৎ সৃষ্ট কোনো কম্পন যখন ভূপৃষ্ঠে আকস্মিক আন্দোলন সৃষ্টি করে, সেটাকেই ভূমিকম্প বলে। ভূমিকম্পন কয়েক সেকেন্ড থেকে মিনিট খানেক পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে এবং পর্যায়ক্রমে একাধিকবার ঘটতে পারে। মৃদু ভূমিকম্প আমরা অনেক সময় অনুভব করতে পারি না, কিন্তু শক্তিশালী বা প্রবল ভূমিকম্প সহজেই অনুভব করা যায়। ভূমিকম্প কি প্রাকৃতিক দুর্যোগ? হ্যাঁ, এটি অবশ্যই একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কোনো একটি দেশ বা অঞ্চল পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে পারে (চিত্র ১.০১)। এমনকি বড় ভূমিকম্প নদীর গতিপথও পরিবর্তন করতে পারে। ভূমিকম্পের ফলে আমাদের অন্যতম প্রধান নদী ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ বদলে গিয়েছে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত বড় ধরনের ভূমিকম্প না হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশ বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পৃথিবীর মাঝে জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা বলে চিহ্নিত।

তোমরা নিশ্চয়ই ২০১০ সালে হাইতিতে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প, ২০১১ সালে জাপানের ভূমিকম্প এবং ২০১৫ সালে নেপালের ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞের কথা শুনেছ। জাপানের ভূমিকম্পের পর সেখানে সৃষ্ট সুনামি নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রে আঘাত করে একটি নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিল।এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে এই ভূমিকম্প হয়? আমাদের ভূগর্ভ (Earth's Crust) কতগুলো ভাগে বিভক্ত, যাদেরকে টেকটনিক প্লেট (Tectonic plate) বলে। এই টেকটনিক প্লেট কিন্তু স্থিতিশীল নয়, এগুলো চলমান। চলমান একটি প্লেট আরেকটি প্লেটে চাপ দেওয়ার কারণে সেখানে শক্তি সঞ্চিত হয়। যখন হঠাৎ করে প্লেটগুলো সরে যায়, তখন সঞ্চিত শক্তি বের হয়ে ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপ করা হয় রিখটার স্কেলে। রিখটার স্কেলে ৫ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প আমরা অনুভব করতে পারি। রিখটার স্কেলে এক মাত্রা বেড়ে যাওয়া অর্থাৎ তার শক্তি তিরিশ গুণ বেড়ে যাওয়া। একটি ভূমিকম্প যত বড় হয় তত দূর থেকে সেটি অনুভব করা যায়।


১.১০ চিত্রে বাংলাদেশ এবং তার আশপাশে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পগুলো দেখানো হয়েছে। ছবিতে নিশ্চয়ই দেখছ বাংলাদেশের ভেতরে সাম্প্রতিক কালে কোনো বড় ভূমিকম্প হয়নি, কিন্তু আশপাশে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পন অনুভূত হয়েছে। ১৮৮৪ সালে মানিকগঞ্জ এলাকায় রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার বড় একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। ১৮৯৭ সালে শিলংয়ে ৮.৭ মাত্রায় একটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। যেহেতু অতীতে এই অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প হয়েছে, তাই আমাদের ধরে নিতে হয় ভবিষ্যতেও হতে পারে। সেটি কখন হবে যেহেতু আমাদের জানা নেই, তাই সব সময়েই প্রস্তুত থাকতে হবে।
ভূমিকম্প হলে করণীয় কী? এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় আছে কি?

ভূমিকম্পের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই, তবে এতে জানমলের ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায় । সেক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিয়ম মেনে ঘর-বাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি করা। আমাদের দেশে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে যে সকল বড় বড় দালান-কোঠা তৈরি করা হয়, সেখানে অবশ্যই ভূমিকম্প প্রতিরোধক ব্যবস্থা থাকতে হবে। তা না হলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে তা ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনতে পারে। ২০১০ সালে হাইতিতে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে তিন লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। অথচ তার থেকে ত্রিশ গুণ থেকে বেশি শক্তিশালী ৮.২ রিখটার স্কেলের একটি ভূমিকম্পে ২০১৪ সালে চিলিতে মাত্র ছয়জন মানুষ মারা গিয়েছিল। তার কারণ ভূমিকম্প প্রবণ চিলি নিয়ম করে তাদের দেশে ভূমিকম্প সহনীয় বিল্ডিং তৈরি করতে শুরু করেছে। এছাড়া ভূমিকম্প হলে জরুরি ভিত্তিতে সরকারি ও অন্যান্য সংস্থার সমন্বয়ে দ্রুত ত্রাণ তৎপরতা ও উদ্ধারকাজ নিশ্চিত করতে হবে এবং তার জন্য আগাম প্রস্তুতি থাকতে হবে। বেশ কয়েকটি বিষয় সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে।


ভূমিকম্পের আগে করণীয়

১. সম্ভব হলে সব বাসাতেই অগ্নিনির্বাপক প্রস্তুতি থাকা দরকার। এর সাথে প্রাথমিক চিকিৎসা কিট, ব্যাটারি চালিত রেডিও, টর্চ লাইট কিছু বাড়তি ব্যাটারি, শুকনো খাবার এবং পানি রাখার ব্যবস্থা করা।

২. কীভাবে ফাস্ট এইড বা প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হয় সেটি শিখে নাও।

৩. বাসায় গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি এবং পানির সরবরাহ কীভাবে বন্ধ করতে হয় সেটি জেনে নাও।

৪. ভূমিকম্পের পর প্রয়োজনে কোথায় কীভাবে পরিবারের সদস্যদের সাথে মিলিত হতে হবে, সেটি আগে থেকে সবার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নাও।

৫. উঁচু শেলফে ভারী জিনিস রাখা যাবে না, ভূমিকম্পের সময় সেগুলো নিচে পড়ে লোকজনকে আহত করতে পারে।

৬. ভূমিকম্পের সময় কী করতে হবে, সেটি স্কুল কলেজ বা কর্মক্ষেত্রে “ড্রিল" করে শিখে নাও।


ভূমিকম্পের সময় করণীয়
১. ভূমিকম্পের সময় ভয়ে এবং আতঙ্কে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হওয়া যাবে না। নিজেকে বোঝাও পৃথিবীর মানুষ ভূমিকম্পের সাথে জন্ম থেকে বসবাস করে আসছে এবং মাথা ঠাণ্ডা রাখলে বড় শক্ত টেবিলের নীচে আশ্ৰয় নাও অথবা ঘরের কোণায় চলে যাও যাতে কিছু ভেঙ্গে পড়লেও সরাসরি গায়ের ওপরে না পড়ে একটা ত্রিভূজাকৃতির জায়গা থেকে যায় তোমার ওপরবাইরে থাকলে আতংকিত না হয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। বিল্ডিং থেকে একান্ত নামতে চাইলে সিঁড়ি দিয়ে নামাই নিরাপদ উঁচু কাঠামো, বৈদ্যুতিক থাম ইত্যাদি থেকে যতদূর সম্ভব দূরে সরে যেতে হবে। ভূমিকম্পের বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব।


২. তুমি যদি ঘরের ভেতরে থাকো তাহলে ভিতরেই থাকা, হুড়োহুড়ি করে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করো না। দেয়ালের পাশে দাঁড়াও। কাচের জানালা থেকে দূরে থাকো। প্রয়োজনে শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নাও। কখনোই লিফট দিয়ে নামার চেষ্টা করো না । ৩. তুমি যদি ঘরের বাইরে থাকো তাহলে বাইরেই থাকো, ঘরের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করো না। ইলেকট্রিক পোল কিংবা বড় বিল্ডিং থেকে দূরে সরে যাও, উপর থেকে মাথার উপর কিছু পড়তে পারে।


৪. কোনোভাবেই ম্যাচ জ্বালিও না, গ্যাসপাইপ ভেঙে বাতাসে গ্যাসের মিশ্রণ আগুনের জন্য খুবই বিপজ্জনক।


ভূমিকম্পের পরে করণীয়

১. বড় ভূমিকম্প হয়ে থাকলে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের পরীক্ষা করে দেখো কেউ আহত হয়েছে কি না। আহত হলে প্রাথমিক চিকিৎসা দাও। গুরুতর আহত হলে হাসপাতালে নাও, মনে রেখো সত্যিকারের বড় ভূমিকম্প হলে হাসাপাতালে অসংখ্য মানুষকে জরুরি চিকিৎসা দিতে হয়। কাজেই যার প্রয়োজন বেশি তাকে আগে চিকিৎসা দেওয়া হবে।

২. পানি, ইলেকট্রিসিটি, গ্যাসলাইন পরীক্ষা করো, যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে সরবরাহ বন্ধ করে দাও। বাসায় গ্যাসের গন্ধ পেলে ঘরের দরজা-জানালা খুলে ঘরের বাইরে যাও।

৩. রেডিওতে খবর শোনার চেষ্টা কর। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে টেলিফোন ব্যবহার করে নেটওয়ার্ক অচল করে দিও না, জরুরি কাজের জন্য ত্রাণ বাহিনীকে টেলিফোন ব্যবহার করতে দাও। বড় ভূমিকম্পের পর টেলিফোন অচল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকতে পারে ।

৪. ক্ষতিগ্রস্ত বিল্ডিংয়ের বাইরে থেকো। ভাঙা কাচ ইত্যাদিতে যেন পা কেটে না যায়, সেজন্য খালি পায়ে হাঁটাহাটি করবে না।

৫. সমুদ্র উপকূলে বসবাস করলে সমুদ্র থেকে দূরে সরে যাও। সুনামি এসে আঘাত করতে পারে।

৬. ধ্বংসপ্রাপ্ত বিল্ডিংয়ের নিচে আটকা পড়লে, ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা না করে উদ্ধারকারীদের জন্য অপেক্ষা কর। নিজের শক্তি বাঁচিয়ে রাখো, উদ্ধারকারী দল এলে তাদেরকে সংকেত দেওয়ার জন্য কোনো কিছুতে নিয়মিতভাবে আঘাত করে দৃষ্টি আকর্ষণ কর।

৭. বড় ভূমিকম্প হলে আফটার শক হিসেবে আরো ভূমিকম্প হতে পারে, সে জন্য প্রস্তুত থেকো।


দলগত কাজ
কাজ
: ভূমিকম্পে করণীয় কাজগুলো দিয়ে পোস্টার এবং লিফলেট তৈরি করে তোমরা এলাকায় বিতরণ কর ।


দলগত কাজ
কাজ: ভূমিকম্পের সময় করণীয় কাজের একটি ড্রিলের আয়োজন কর।

 



 

Content added By
Promotion